Tuesday, December 11, 2007
নাটকে সমকাল : ‘আমিনা সুন্দরী’(Contemporaneity in Theatre: AMINA SUNDARI)
সময়ই নির্ধারণ করে ‘শিল্পের জন্য শিল্প’ নাকি পূর্ণিমার চাঁদ হবে ঝলসানো রুটি। এই সত্যের ছায়া মাড়িয়ে, পকেটের টাকা বিকিয়ে যখন মঞ্চনাটক প্রযোজিত হয় তখন প্রশ্নটা প্রাসঙ্গিক হয় : কেন এই নাটক, এই সময়ে?
সময় এখানে অস্থির। লুটিপুটিখাইযাই পীড়নে গণতন্ত্র, অসা¤প্র্রদায়িকতা, সাম্যবাদ, উন্নয়ন শব্দগুলো মেরুকরণ পদ্ধতিতে বারবার চর্বনে শেষে হয় বাণিজ্যবসতিলক্ষ্ণী। ফুলেফেঁপেওঠা ইলেকট্রনিক মাধ্যমগুলো বরাবরই সমসাময়িক ভাবনার অঙ্কুরোদগমে ব্যর্থ থাকে। এবং এই ব্যর্থতা আমাদের মঞ্চ ভাবনায় যোগ করে কালীন দায়িত্ববোধ। ফ ল া ফ ল : নাটক ‘আমিনা সুন্দরী’। সময়ের দাবীপূরণীয় সক্ষমতার সামনে ষোড়শ-সপ্তদশ শতাব্দীর লোকজ কাহিনী দাঁড় করিয়ে দেখি ’সীতার’ পদাঙ্ক অনুসারী আমিনাদের চেহারা বদলায়নি। একদিকে সন্তিপনার আব্দার, অন্যদিকে তাকে ঘিরে শরীরীকামনা, দুয়ের ব্যস্তানুপাতের সুতোয় আটকে থাকে মানবিক মূল্যবোধ যা কেবলই নিমজ্জমান। পরিণতি তাই আজও স্থির থাকে। প্রথম আমিনারা নিরাপদ বেষ্টনীর ছায়ায় গণতান্ত্রিক নীতিমালায় গণধর্ষিত, দ্বিতীয় আমিনারা তরল আগুনে অলংকৃত, আর তৃতীয় আমিনারা সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ সাক্ষী রেখে লাঞ্ছিত হয়। সমাজের সকল স্তরে লক্ষ কোটি আমিনারা নিজ গৃহে দেহমননেমেধায়স্বপনে নির্যাতিত হয়, জাতীয় বৈঠকখানায় পিঁড়ি ভাগাভাগিতে আমিনাদের আরেকবার পুতুল খেলতে বলা হলে নাটকে আমিনাদের পরিণতি কোনো বাহুল্য তৈরি করে না, বরং যন্ত্রণা আর প্রবঞ্চনার ককটেলের বিনিময়মূল্যে কালের ঘাটে ঘাটে মধু শোষণে উপস্থিত হয় একজন নছর, এছাক, ভোলা কিংবা মুনাফ কাজী। তখন যেন ‘আমিনা সুন্দরী’ আর ‘রূপসী বাংলা’ এক উভমুখী বিক্রিয়ার সাম্যাবস্থানে এসে প্রশ্ন তোলে এই বিশাল জনপদই কি একজন ‘আমিনা সুন্দরী’ নয়? উত্তরের আশায় নাট্যদলটি খোঁজে একজন সোলায়মান। তার সংকটে তার প্রিজমেই বিচ্ছুরিত করে অসংখ্য সোলায়মান তৈরির সাহস করে নাট্যদল থিয়েটার আর্ট ইউনিট।
এই নাটকের অন্যতম প্রাপ্তি বোধ করি আমাদের লোকজ সাহিত্যের শক্তিমাত্রা উদঘাটন। দিনমজুর, সাম্পানওয়ালা, নিরক্ষর গায়েনের এই পালা চর্চিত হয়েছে সাধারণের মুখে মুখে, দীর্ঘদিন। এই পালা লালিত হয়েছে লোকজ উৎসবের গীতল সন্ধ্যায়। এবং এ তো প্রমাণিত যে এই জনপদ, তার মানুষজন নারীর প্রতি সমবেদনাশীল থেকে তাদের কষ্টের কথা স্বীকার করেছে, কেঁদেছে,
আমিনাকে
ভালবেসেছে, নারী নির্যাতন ঘৃণা করেছে এবং এই সব করেছে সবরকম সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতার ঊর্দ্ধে, ফতোয়াবাজদের বিরুদ্ধে থেকে। আমরা উপলদ্ধি করি ধর্মীয় গোড়ামি কখনোই ভর করেনি এই মাটির শেকড়ে।
সমসাময়িকতার প্রশ্নে নাটকটির সবচে’ বড় ব্যাখ্যা হতে পারে, নাটকের ক্ষেত্রে উত্তরাধুনিক চেতনার উন্মোচন ও বিকাশ। বিশ্বায়নের চক্রে ঢুকে আজকের উঠতি সমাজ যত সহজে হলিউডি হয়ে উঠছে তত সহজেই ভুলতে বসেছে নিজের ভিত্তি পরিচয়। পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলোর শিল্পসাহিত্যদর্শনের প্রতি নগ্ন ভাবালুতা এবং ধার করা বুদ্ধিবৃত্তিক বেলেল্লাপনার নিচে জীর্ণ আমাদের জাতীয় ঐতিহ্য, উপেক্ষিত শ্রমজীবী, দরিদ্র গণমানুষের সংস্কৃতি। এমতাবস্থায় এই নাটক একইসাথে স্বীয় মাটির স্বাদ পুনরুদ্ধারের এবং পুজিঁবাদী সংকট মোকাবেলায় নতুন বৈপ্লবিক ব্যুহ তৈরির প্রচেষ্টা। পশ্চিমা সংস্কৃতির সাম্রাজ্যবাদী কুহকিনীর বিরুদ্ধে আজ বিশ্বের নানা কোণে উচ্চারিত প্রান্তিক কণ্ঠে দ্যোতমান ব্যঞ্জনে ‘আমিনা সুন্দরী’-এর সমসাময়িকতার কথা। তাই সমসাময়িকতার প্রশ্ন ডিঙিয়ে ‘আমিনা সুন্দরী’ আবার অধুনা-আধুনিক আবহে বিশ্ব-মঞ্চ স্রোতে যাত্রা শুরু করে, যা কিনা যুগপৎ বিশ্বজনীন, যুগপৎ স্থানিক শিল্প।
শঙ্খগ্রীব ..... - ছবি> নূর আলম
৬-১২-০৭
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment